ভোর বেলা আচমকা চোখ খুলে যদি দেখতাম বৃষ্টি পড়ছে বেশ জোরে মনের ভিতরটা আনন্দে টগবগ করে উঠত। আর আজ স্কুল যেতে হবে না। কি মজা ! শুরু হয়ে যেত জোর প্রার্থনা বৃষ্টি কমিয়ে দিও না ঠাকুর। আর পরীক্ষা থাকলে তো কথাই নেই। তখন আরো বেশী করে প্রার্থনা।
যখন সব ব্যর্থ করে , এত ডাকাডাকি - সাধাসাধিও কাজে দিত না , মানে স্কুলের ড্রেস চাপিয়ে সাথে ব্যাগ চাপিয়ে , রেইনকোট চাপিয়ে বা ছাতা মাথায় স্কুল যেতেই হত তখন মনের অবস্থা যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিকের সমান।
স্কুল বাস এর অপেক্ষারত আমি আর আমার সাথে আরো কিছু সহপাঠী যারা আমার মতই প্রার্থনা করে বিফল হয়েছে। তবে কিছু সৌভাগ্য প্রাপ্তরাও আছে যারা অনুপস্থিত। যাক তাদের কথা ভেবে কাজ নেই। ছাতা মাথায় আমরা বাসের অপেক্ষারত।
এক সময় যখন বাস আসার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেল বোঝা গেল স্কুল বাস আর আজ আসবে না , তবু ফেরা যাবে না , পরীক্ষা আছে যে ! এতএব পাবলিক বাস এ ভিড় ঠেলে স্কুল এ দৌড়াও।
আমার স্কুলের সামনে বিশাল দুটো মাঠ পেরোতে হত। বৃষ্টি তে বাস থেকে নেমে ছাতা হাওয়ার বেগে উড়ে যাচ্ছে সেই ছাতা জোরে ধরে নিয়ে প্রায় দদৌড়ে মাঠ পেরোনো তখন কেমন লাগত ঠিক অনুভব করার সময় পেতাম না। আজ স্বীকার করছি খুব মিস করি , খুব। মাঠের চারিপাশ বৃষ্টি তে সাদা , তাতে কয়েকটা সবুজ স্কার্ট আর সাদা শার্ট ছাতা মাথায় ছুটে -হেঁটে চলেছে। শুধু নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ আর বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্কুলের গেট পর্যন্ত কতটা কম ভিজে তাড়াতাড়ি পৌছানো যাবে সেই চেষ্টা চলছে । অবশ্য কিছু এমন জনেরা ও আছে যারা ভিজতে মজা পাছে। তারা আবার পা বাড়িয়ে বুট জুত ভেজাচ্ছে বৃষ্টির জলে , কখনো বা জমা জলে ছলাত করে লাফিয়ে নিচ্ছে। আমি ওই দলে তখন পরতাম না। বর্ষা কখনই আমার প্রিয় ঋতু নয় . তবু আজ কখনো কখনো মনে হয় একটু লাফিয়ে নিলে কী বা এসে যেত !
যাইহোক করে কাক ভেজা হয়ে স্কুল গেট পর্যন্ত পৌছানো গেল। ক্লাস এ এসে দেখা গেল কম উপস্থিতি। আমাদের স্কুলের মাসিরা আর যে কয়েকজন দিদিমনিরা এসেছেন তারা বলতে থাকতেন তাড়াতাড়ি ভেজা জামা ফ্যান এর হাওয়াতে শুকিয়ে নাও , নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আমরা তখন বাধ্য ছাত্রীরা সব ফ্যান এর তলায় এই বলাবলি করছি এই আজ কি পরীক্ষা হবে রে ! প্রশ্ন সবাই করছি , উত্তর টা কেউ জানি না। কারোর সাহস ও নেই যে গিয়ে দিদিদের জিজ্ঞাসা করি।
আবার শুরু হল প্রার্থনা , যেন বৃষ্টি না কমে আর বেশি ছাত্রী যেন না আসে আজ। কি অদ্ভুত না ! একটু আগে বৃষ্টি কমার জন্যে যারা প্রার্থনা করছিল এখন তারাই বৃষ্টি না কমার জন্যে প্রার্থনা করছে। এখন এটা ভাবলেই হেসে ফেলি।
সময় যাওয়ার সাথে সাথে উত্কন্ঠা বেড়ে যাচ্ছে। ক্লাসের বাইরে আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে , একবার কেউ এসে বলছে যে টিচার্স রুমে শুনে এসেছে দিদিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন পরীক্ষা হবে। শুনেই আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। আবার পরক্ষনেই আরেকজন এসে বলছে মোটেই না , এত বৃষ্টি তে অনেকেই আসেনি , দিদিরা তো দুবার পরীক্ষা আর নেবেন না , একদিনেই হবে আর সেটা অন্য দিন হবে। শুনে বুঝতে পারছি না বইতে একবার চোখ বুলিয়ে নেব কি নেব না !
ক্লাসের সাথে সাথে জানলার বাইরেও সমানে নজর রেখে যাওয়া , বৃষ্টি কমছে কি কমছে না ! একজন করে ছাত্রী আসছে আর আমাদের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে সংখ্যা টা বাড়তে দেখে। স্কুলের রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির গন্ধ আসছে মানে আজ টিফিনে খিচুড়ি।
ওই প্রার্থনার ঘন্টা বাজল। বৃষ্টি কি কমল ! উফ, কী উত্কন্ঠা ! এইটুকু তখন বুঝতে চাইতাম না যে কোন একদিন তো পরীক্ষা হবেই ! তখন ভাবতাম পরিক্ষার তারিখটা বৃষ্টির জন্যে পিছলে আরেকটু ভাল প্রস্তুতি নেবার সময় পাব , আরেকটু ভালো করে পড়ব। যদিও সেই পড়া আর কখনই হত না।
বেলা শেষ , বৃষ্টি এখনো পড়ছে তবে সকালের থেকে কম , আমরা এখন অনেকটা শুকনো , খালি ওই সকালের ইচ্ছে করে ভেজা মেয়েগুলো আবার ইচ্ছে করে ভেজার চেষ্টা করছে। না , পরীক্ষা আজ আর হয়নি , আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে। হর্ষ চিত্তে টিফিনে গরম গরম মটরশুটি দেওয়া পাতলা খিচুড়ি খেয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে কেউ রেইনকোট পরে বাড়ি ফিরছি ওই চেনা মাঠ পেড়িয়ে।
এখন চারপাশটা কম ঝাপসা , পাশের গাছগুলো অনেকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , অনেক পাতা নীচে পড়ে রয়েছে যেন বলছে মনে রেখ এই দিন , এই পথ , এই স্মৃতি , দেখো যেন ঝাপসা না হয় ! .........