চারদিকে চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে থাকা অনন্ত নিশ্চুপতা , মাঝে মধ্যে বুকের পাঁজরের মধ্যে চেপে বসে নিষ্ঠুর পিশাচের মত , দম নেবার অবকাশ দেয় না। কখনো ঝিম ধরিয়ে আবার সজোরে টুঁটি চেপে ধরে। ভাবাবেগ নিয়ে খেলার পরিণাম এই অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা। কষ্ট হয় , অব্যক্ত কষ্ট গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। চোখ দুটো জ্বালা করে। মনে হয় এই খেলার কী শেষ নেই ! একী বিভৎস রূপ অসময়ের ! আর কতক্ষণ ভোগ করতে হবে এ যন্ত্রণার খেলা !
স্বার্থ নেশা এমন জাল বিছিয়ে রেখেছে যে বেরোবার উপায় নেই। লোভে ঢেকে গেছে পারস্পরিক স্নেহের আদ্রতা , ভদ্রতার মুখোশ পরে রয়েছে দম্ভ , ঐতিহ্যের নাম করে যে যেমন করে পারছে বৈভব দেখিয়ে চলেছে , কী নির্লজ্জ তার প্রদর্শন ! আত্মগ্লানি।, অনুশোচনা নামক শব্দগুলি নিঃশেষ হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর তার স্থান নিয়েছে নিজমুখীতা , আত্মপ্রেম , সংকীর্ণ মানসিকতা। নিজেকে ভালবাসার এত মোহ যে মোহান্ধ হয়ে অপরের হিতাহিত চিন্তা লুপ্ত হয়েছে। শুরু হয়েছে এক পৈশাচিক খেলা। অন্যের মূল্যবোধ কে আঘাত করা যার দ্বারা এক অনাবিল আনন্দ ও মানসিক শান্তি চরিতার্থ করা যায়।
কিছুমাত্র অন্যায় বোধ নেই এই খেলায়। প্রতারণার অপর নামান্তকরণ এই খেলা। নিজ স্বার্থে কাউকে ব্যবহার করে প্রেম প্রেম খেলা। কারোর আবেগ , অনুভূতি , গভীর বিশ্বাস , প্রেমের প্রকাশ , তার স্বপ্রতিভ অভিব্যক্তি , অব্যক্ত অনুরাগ - সবকিছু নিয়ে খেলা করা। এ খেলার নিয়ম হল বুঝেও না বোঝার নিঁখুত অভিনয় করে যাবে খেলোয়াড় , কখনো প্রকাশিত হবে না যে এখানে সবটাই খেলা ছিল বা স্পষ্ট করে বললে খেলাচ্ছলে প্রতারণা।
আর বুঝে গেলে খেলা শেষ নয় , বরং নতুন করে অন্য খেলা শুরু , শুধু খেলোয়াড়ের নির্বাচিত স্থান , কাল , পাত্র বদলে যাবে। এই খেলায় খেলোয়াড়কে কিন্তু দায়ী করা চলবে না। প্রেমে প্রতারণা করেছে বা ঠকিয়েছে এ অপবাদ তো তাকে মোটেই দেওয়া যাবে না। খেলোয়াড় যুক্তি দেবে তার স্বপক্ষে যে সে সম্পূর্ণ নির্দোষ , অবগত নয় । সে তো বন্ধুত্বের হাথ বাড়িয়েছিল ! সেই বন্ধুত্বকে প্রেমে পর্যবসিত করার তার কিছুমাত্র অভিপ্রায় ছিল না। অপরপক্ষ ভুল বুঝেছে , তার বন্ধুত্বের সংজ্ঞা অন্যভাবে ব্যখ্যা করেছে।
যদি তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় এমন কিছু মুহূর্ত যা প্রত্যক্ষ রূপে বন্ধুত্বের সাথে সাথে আরো বিশেষ সম্পর্কের নির্দেশক। এমনকিছু ভাবনা সে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে প্রকাশ করেছে যা বন্ধুত্বের অতিরিক্ত ভাললাগা বা ভালবাসার প্রতীকস্বরূপ। তখন খেলোয়াড় তার মোক্ষম চালটি প্রয়োগ করবে। কিছু মুহূর্ত সে স্মরণেই আনতে পারবে না , যেন তার স্মৃতিপট থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে সেগুলি আর কিছুক্ষেত্রে নীরব থেকে তার যোগ্য খেলোয়াড়ী মনোভাব সে চিনিয়ে দেবে।
কারণ খেলোয়াড় ভালমত অবগত যে খেলার কোন অংশে আত্মরক্ষা করা উচিত , আর আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্রই হল মৌনতা যাতে প্রতিপক্ষ যাকে সে বন্ধুত্বের আবরণে মুড়ে রেখে খেলা চালিয়ে যাচ্ছে সে কোনরূপ প্রতি - আক্রমণ না করতে পারে বা তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ সংগ্রহ না করতে পারে , তবেই তো খেলা সুচারুরূপে সম্পন্ন হবে এবং শেষ বিজয়ীর হাসিটি খেলোয়াড়ের মুখে উদ্ভাসিত হবে। খেলোয়াড় এখানে কোন বিরোধীতার সম্মুখীন তো হয়ই না বরং বিপুল সমর্থন লাভ করে তার পরিবারবর্গ ও বন্ধুমহল থেকে। এ খেলায় তাকে অজেয় বানাতে এদের সহযোগিতা ও পরামর্শ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আর খেলোয়াড়ের ক্রীড়াঙ্গনের পারদর্শীতা এখানেই কিন্তু শেষ হবে না , খেলোয়াড় তার নিজের অপরাধবোধ যা মনের অন্তঃস্থলে কিছুটা কিছু সময়ের জন্য থেকে যায় কিন্তু প্রকাশ কিছুমাত্র দেখায় না তাতে প্রলেপ দিতে বিপক্ষকে দায়ী করে। পাল্টা অভিযোগ জানায় তার খেলোয়াড়ী চরিত্র বুঝতে অক্ষম তার খেলার সাথীটি , বন্ধুত্ব ও প্রেমের ব্যবধান রাখতে সে জানে না।
ব্যাস , এখানেই খেলোয়াড়ের বাজীমাত। নিঁখুত দৃশ্যাঙ্কন ও অভিনয় দিয়ে সে ক্রীড়াঙ্গনে তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখে দেয় আর মনে মনে বাহবা কুঁড়িয়ে পরবর্তী খেলা শুরু করবার জন্য দৃশ্য , স্থান , পাত্র নির্বাচন করে , শুধু অপেক্ষা কাল অর্থাৎ সঠিক সময় যখন আবার নতুন খেলা শুরু হবে।
আর যার সাথে খেলা করা হয় তার কী হয় ? কখনো সে নিষ্ফল আক্রোশে দগ্ধ হয় , কখনো প্রতিশোধস্পৃহ মনোভাব প্রকাশ করে , কখনো নীরবে অশ্রুপাত করে পরাজয়ের গ্লানি বহন করে , কিন্তু কোন অবস্থাতেই খেলোয়াড়কে পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানাবার সাহস পায় না , শঙ্কিত হয় আবার যদি নিপুণ খেলোয়াড় তার বিশ্বাস এবং ভাবাবেগের সাথে খেলা শুরু করে দেয় ! পুনরায় পরাজয়ের গ্লানি বইবার শক্তি বা সাহস আর তার অবশিষ্ট থাকে না। সে ক্রীড়াঙ্গন ত্যাগ করার সংকল্পই স্থির করে। পরবর্তী সময় কখনো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে খেলোয়াড়ের পরবর্তী খেলা দেখতে হয় তাকে নাহলে কালের অতল গহবরে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়। হারিয়ে যায় তার সেই স্বপ্ন , সেই সম্পর্ক যাকে সে সত্য ও সুন্দর ভেবে ভুল করেছিল।
খেলোয়াড় স্বগর্বে বিজয়ীর মুকুট পরে হর্ষ চিত্তে পরবর্তী খেলায় মনোনিবেশ করে পুনরায় ক্রীড়াঙ্গনে পদার্পণ করে। শুরু হয় বন্ধুত্বের আবরণে মোড়া আরেক দান প্রেম প্রেম খেলা।
এই নির্লজ্জ খেলা চলতে থাকে। খেলোয়াড় আর তার সমর্থকেরা উপভোগ করে , প্রশ্রয় দান করে। কেউ যে প্রতিবাদ করবার নেই ! বিপক্ষ যে কম শক্তিসম্পন্ন , কোন অনুযোগ জানাতে চাইলেও খেলোয়াড় হয় এটি ভদ্রভাব দেখায় নয় নিস্পৃহ আচরণ করে। জমে ওঠে খেলা। কেউ উচ্বস্বরে বলে না -
" এবার থাম , খেলা শেষ " .